নিজস্ব প্রতিবেদক :
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলকে ফ্যাসিস্ট বলায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনকে সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর নিকট তাঁকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার জন্য বলেছেন শিক্ষক সমাজ।
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এ কথা বলা হয়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাবলি বিষয়ে শিক্ষক সমাজের প্রেসব্রিফিং লিখিত বক্তব্য পাঠকালে শিক্ষক সঞ্জয় কুমার সরকার বলেন, আমরা
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার গত কয়েকদিন ধরে অনাকাঙ্ক্ষিত কতিপয় ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ঘটনাগুলোর বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ, প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ নিম্নে তুলে ধরছি।
এসময় তিনি বলেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীকে ফ্যাসিস্ট বলে গালি দিয়েছেন। অথচ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ই বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান যেখানে বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা পুলিশের গুলির সামনে বুক
পেতে দিয়ে পেটোয়া পুলিশ বাহিনীকে প্রতিহত করে প্রথম বিজয় অর্জন করেছিল। সেই অকুতোভয় শিক্ষার্থীদের সমর্থনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সকল রকম হয়রানি ও নির্যাতনের ভয় উপেক্ষা করে প্রেস রিলিজ রূপে বিবৃতি প্রদান করে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
অপরদিকে আমরা প্রমাণ সহকারে জানি উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন নিজে ছিলেন ফ্যাসিস্ট শক্তির একজন চিহ্নিত দোসর। ২০২৪ সালের আমি-ডামির নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষক ও পেশাজীবীরা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তাঁদের সেই বিবৃতিপত্রে ১০৮ নং স্বাক্ষরকারী ছিলেন আজকের এই উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন। এমন চিহ্নিত ফ্যাসিস্ট বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলকে ফ্যাসিস্ট বলেছেন- এর চেয়ে লজ্জার ও ঘৃণার কিছু হতে পারে না। আমরা তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই
এবং আমরা দাবি জানাচ্ছি এই বক্তব্যের জন্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর নিকট তাঁকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে।
তিনি বলেন, এছাড়াও তিনি উক্ত সংবাদ সম্মেলনে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এযাব ৎকালের সকল নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। এই কথা দ্বারা তিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অন্যায়ভাবে আহত করেছেন। আমরা তাঁর এই বক্তব্যেরও তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এই কথার জন্যও তাকে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের নিকট ক্ষমা চাইতে হবে।
তিনি বলেন, গত ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়ে বিগত পাঁচ মাসেও তিনি একটি সিন্ডিকেট সভা ডাকতে পারেননি, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ১৮(২) ধারামতে প্রতি ৩ মাসে একটি সিন্ডিকেট সভা আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত গত ১১ ফেব্রুয়ারি এ মর্মে পত্র দেয়া হয় যে, ১৪ ফেব্রুয়ারি ৩টায় ভিসির বাসভবনে একটি সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু অধ্যাপক ক্যাটাগরিতে মনোনীত সিন্ডিকেট সদস্য ড. মোঃ মুহসিন উদ্দীন আমাদের জানিয়েছেন যে, উক্ত আহ্বানপত্রের সাথে কোনো আলোচ্যসূচি দেয়া হয়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনুমিত হয় যে, এটি ছিল একটি গোপন এজেন্ডার দুরভিসন্ধিমূলক সিন্ডিকেট সভা। শিক্ষার্থীরা এই সিন্ডিকেট সভা না হতে দেয়ার লক্ষ্যে ভিসির বাসভবনের মূল গেটের সামনে জড়ো হয়ে সদস্যদেরকে ঢুকতে বাধা দেয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য উপ-উপাচার্য মহোদয়, ট্রেজারার মহোদয় ও সিন্ডিকেট সদস্য ড. মোঃ মুহসিন উদ্দীন গেটে অপেক্ষা করতে থাকেন যাতে প্রক্টরিয়াল টিমের সহায়তায় হলেও তাঁরা সভায় ঢুকতে পারেন। কিন্তু আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও তাঁরা ঢুকতে পারেননি। তখন রেজিস্ট্রার তাদের একজনকে জানান যে, সভাটি একমাত্র আলোচ্য বিষয়ের বিশেষ সভায় রূপান্তর
করা হয়েছে এবং তাঁরা যেন অনলাইনে সভায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তখন রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে অনলাইনে আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগই ছিল না।
কার্যদৃষ্টে মনে হয় কর্তৃপক্ষের ইচ্ছেই ছিল এই সদস্যগণ যাতে আলোচনায় কার্যকর অংশগ্রহণ করতে না পারেন সেই ব্যবস্থা করা। এছাড়াও সদস্যগণের বিবেচনা অনুযায়ী সেই একমাত্র আলোচ্যবিষয়টি আইনিভাবে বৈধ আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠার যোগ্য ছিল না। আলোচ্যবিষয়টি ছিল- “বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শৃঙ্খলা বোর্ড বা সংবিধি না হওয়া পর্যন্ত সরকারী কর্মচারী আইন অনুযায়ী শৃঙ্খলা আইন প্রযোজ্য হবে মর্মে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ’। খুবই অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর এক আলোচ্য বিষয়। শৃঙ্খলা বোর্ড কীভাবে সংবিধির বিকল্প হতে পারে আল্লাহ মালুম! শৃঙ্খলা আইন নামে বাংলাদেশে কোন আইন আছে বলে আমরা শুনিনি। এছাড়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ৩৫, ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ ধারায় সংবিধি ও বিধি প্রণয়নের যে বিধান রয়েছে তদনুযায়ী সরকারি কোনো বিধি এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তার ওপর চাপিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সর্বোপরি আলোচ্যবিষয়টি যেভাবে লেখা হয়েছে তাতে দেখা যায় উক্ত সরকারি আইন বা বিধি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য হবে- এমন সিদ্ধান্ত আগে নিয়ে তারপরে আলোচনার কথা বলা হচ্ছে, যা কার্যত আর আলোচনার সুযোগই রাখে না। এই সব বিবেচনায় নিয়ে উক্ত তিনজন সদস্য সভাটি বয়কট করেন।
কিন্তু জানা যাচ্ছে, স্বেচ্ছাচারী উপাচার্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সদস্যের অংশগ্রহণ ব্যতীতই উক্ত সভা অনলাইনে সম্পন্ন করেছেন এবং সেখানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩৫, ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ ধারার নির্দেশনা অমান্য করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সরকারি কর্মচারীদের জন্য তৈরিকৃত আইন বা বিধি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের
জন্য প্রযোজ্য হবে। এরূপ সিদ্ধান্ত অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ এবং ইহা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইন্টেলেকচুয়াল ও একাডেমিক স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে হরণ করবে বলে আমরা মনে করি। তাই এই অবৈধ সিদ্ধান্তের আমরা তীব্র নিন্দা জানাই এবং অবিলম্বে তা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রবিক্ষোভ বিষয়ে উপাচার্যের নির্দেশে মামলা হয়েছে বলে আমরা জেনেছি এবং সেই মামলার এজাহারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য মহোদয়, ট্রেজারার মহোদয় ও সিন্ডিকেট সদস্য ড. মোঃ মুহসিন উদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। উপাচার্যের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারের বিরুদ্ধে এমন মামলার এজাহারে অভিযোগের ঘটনা অত্যন্ত নজিরবিহীন ও ন্যাক্কারজনক। আমরা এই ঘটনারও তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে এই অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
একইসাথে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক সকল মামলার প্রতিবাদ জানাচ্ছি ও উক্ত মামলা অতিদ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের সকল ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবির প্রতিও আমরা সুদৃঢ় সহমত পোষণ করছি। আমাদের এই প্রতিবাদ বিবেচনায় নিয়ে সকল দাবি অবিলম্বে পূরণপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য উপাচার্য মহোদয়ের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। এই দাবি উপেক্ষা করা হলে শিক্ষক সমাজ কঠিনতর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সিন্ডিকেট সদস্য ড. মোঃ মুহসিন উদ্দীনসহ শিক্ষকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।